পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব- ১৯ )
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৭ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:৪২:৩৫ সকাল
মিথিলা বাবু!
এইচ এস সি পরীক্ষার সময় সারাটা সময় ধরে শরীরটা খুব খারাপ গেলো। জন্ডিসে পড়লাম। কখন পরীক্ষা শুরু হলো , কখন শেষ হলো বুঝলাম না। সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিলো, তবু পাস করলাম। ডাক্তার পুরোপুরি বিশ্রামে থাকতে বললেন। একেবারে বসে থাকা মানসিক যন্ত্রণায় ভোগাবে বুঝে বি এল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। লাভলিকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হল।
ততদিনে জেনেছি কেন লাভলিদের ঘরের ঝড় ঝাপ্টা আমার গায়ে লাগেনি। বাবা মাকে তারা পরোক্ষ হুমকি ধমকি সহ খবর ঠিকই পাঠিয়েছিলেন। পরীক্ষার কথা বলে বাবা মা তাদের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে কী হত বলা মুশকিল, আমাকে নিয়ে আজরাঈলের সাথে কাড়াকাড়ি করতে হওয়ায়ই হয়তো - বাবা মা আমার কষ্টটা বুঝলেন।
একদিন মা আমার বিছানায় মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথাটা তুললেন। বললেন, 'বাবা, তারা ব্যাপারটা কিছুতেই মানবেন না। বাপ মার মনে কষ্ট দিয়ে কোন ছেলেমেয়ে সুখী হয় না। '
আমার দু:খে হাসি পেলো। বেচারি মা। আমার কারণে আব্বা আম্মা শাঁখের করাতে পড়ে গেছেন। কিন্তু ওকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে!
আমি চুপ করে রইলাম।
মা বোঝাতে লাগলেন। ' মেয়েটার বয়স কম, এখন আবেগে যা করছে তা বিয়ের পর ওর নিজেরই খারাপ মনে হবে। পরিবারে অশান্তি করে কিছু পেয়ে শান্তি হয় না বাবা।
আমি চুপ করে রইলাম। লাভলিকে ছাড়া আমার কোন ভালোতেই শান্তি হবে না। আমি জানি। একবার মনে হলো, যদি আমার এই সম্পর্কটা না থাকতো! মা বাবাকে ওরা অনেক কষ্ট দিয়ে কথা বলেছে। সব দোষে দোষী করেছে। আমারই স্বার্থে তারা একটু রাগ ও করতে পারে নি। এত কষ্ট! কিভাবে এমন একটা কাজ করলাম!
নিজেকে ছাড়া ভাবতে কখনো শিখিনি। নিজের দু'চারটা স্বার্থ নিয়ে নিজের মধ্যে ডুবে ছিলাম। নিজেকে পৃথিবীর তো দূরে, এমনকি দেশটার একজন হিসাবেও কেমন আছি দেখিনি। এত ছোট ছিল চিন্তার গন্ডী!
আমার ভাবা না ভাবায় দেশের বা পৃথিবীর কিছু আসে যায় নি। আমার যা কিছুই হোক, দেশ দুনিয়াও চলছিল নিজের মত।
রাজনৈতিক চাল বদলাচ্ছিল দেশে। সামরিক শক্তি দিয়ে উঠে আসা প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতন হল। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেন। সে এক অভূতপূর্ব এক ব্যাপার ছিল। মৌশুমের প্রথম বৃষ্টির মত। সবার উচ্ছাস সবাইকে স্পর্শ করল। নতুন সময় আশা জাগালো। তবু বিরোধ ছাড়া রাজনীতি কল্পনা করা যায় না।
এই অবস্থায়ও দেশের মানুষেরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল। নতুন সংসদীয় পদ্ধতিতে দেশীয় রাজনীতির যাত্রায় অনেকের ই আশা এবং মোহ ভঙ্গ হল। এই সময়ে চরমপন্থী দলগুলো ধীরে ধীরে উপজেলা গুলো থেকে নিজেদেরকে বিভাগীয় শহরগুলোতে ঢুকাবার পরিকল্পনা করে। তাঁরা খুলনা শহরকে কৌশলগত কারণে সর্বাগ্রে বেছে নেয়।
আমরা সাধারণ মানুষেরা কেউ রুটি রুজি,কেউ চাল ডাল, কেউ প্রেম পরিণয়ে, কেউ বিনোদনে ব্যস্ত থাকি। একই পৃথিবীতে হাজার জীবন হাজারভাবে প্রতিদিন বদলাতে থাকে। দিনগুলি যেতে থাকে।
এদিকে ছোট খালা আলাদা হয়ে যাবার পরে খালুও চাকুরী ছেড়ে তার গ্রামে চলে যান। তবে শহরের বাড়িটাও থাকে। গ্রাম এবং শহরের বাড়ি দুটো যায়গাতেই ইচ্ছেমত থাকা শুরু করেন তিনি। গ্রামে গিয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একজন প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হন।
ডুমুরিয়া মূলত চিংড়ির ঘের এবং চাষাবাদকে কেন্দ্র করে ওখানের অর্থনৈতিক পরিমন্ডল বিস্তৃত। সেখানের নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক চাষীদেরকে নিজেদের ইচ্ছেমত সম্পন্ন বিত্তশালিরা ব্যবহার এবং শোষণ করে আসছিল। খালু এদের একজন লীডারে পরিণত হয়ে যান। আর মৃণাল শোষিত পক্ষকে একত্রিত করে একটা জোটে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মৃণাল চরমপন্থী দলগুলোর নজরে পড়ে যায় ওর অভূতপুর্ব সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে। পুর্ব বাংলা কম্যুনিস্ট পার্টির একটা মাঝারি গোছের পদ দিয়ে ওকে দলে ভিড়িয়ে নেয়া হয়।
এভাবে মৃনাল ওর নিজের মত করে যে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা একটি উপজেলায় নিজেদের মত কিছু সংখ্যালঘুর ভাগ্যকে মোটামুটি মানে নিয়ে আসার জন্য লড়তে চাইলো, তাকে কিনা একটি বৃহৎ দলের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে স্রোতের সাথে চলতে বাধ্য করা হল। কিন্তু সে এই স্রোতের মাঝে এসে পড়ে দেখল এই দলগুলোর তাত্ত্বিক নেতাদের তত্ত্বে এবং বাস্তবে তাদের কর্মপদ্ধতির মাঝে বিশাল ফাঁক এবং প্রভেদ রয়েছে। তাই সে পিছু হটে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাইলো। কিন্তু এটা এমনই এক রাজনৈতিক পাক, একবার আসাতো যায়, কিন্তু এতটা তীব্র স্রোতে আর পিছু ফেরা যায় না। ততোদিনে মৃণালের নাম লোকাল থানায় এবং বিভাগীয় শহরের ল এন্ড অর্ডার সেলের লিস্টে চলে এসেছে। ওর দলের মহারথীরাই সেটা ইচ্ছে করে তুলতে সাহায্য করেছে। তবে এগুলো মৃনাল যখন দলের শীর্ষ পর্যায়ে চলে যায়, তখন জেনেছিল।
তখন আর জেনে কী লাভ?
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৮১০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নাহ, আমিতো ব্লগেই ঢুকতে পারি নাই। কষ্ট লিখতে কখনোই আমার হয় না।
ইনশা আল্লাহ।
ভালো থাকবেন আপনি।
শুধু নিজেকে নিয়েই- স্বীয় স্বার্থকে হস্থগত করার দূর্বিণীত আকাংখা একটা সময় বিরাজ করে মানুষের মধ্যে!
তখন আসলে প্রকৃত ভাল-মন্দের বিচার করার ক্ষমতাও বেশী একটা থাকে না!
ফলশ্রুতিতে........বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন!
দীর্ঘ বিরতীতে দেয়া উপস্হাপনা মুগ্ধতা ছড়ালো আগের মতই!!
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন